অমিতাভ মৈত্র ও অনুপম মুখোপাধ্যায়
দ্বিতীয় পর্ব
অনুপম
আপনার কবিতার মধ্যে এক আশ্চর্য স্থানকাল
থাকে। তার উৎস কি আপনার শৈশব থেকে কৈশোরের মধ্যে কোথাও? আমার মনে হয়, শিশু প্রদীপ
যে কোনো গাছে বা বাড়িতে বা টেলিগ্রাফ পোস্টে সেটাকে ছাপিয়ে একটা অন্য আকার ও উপস্থিতি
খুঁজে পেত। আপনার ছেলেবেলা কি এডগার এলান পো-র কোনো চরিত্রের মতো? অসুখ
সারে, কিন্তু অদ্ভুত সাদা করিডোরে কালো বিড়াল ঘুরে বেড়ায়, এমন
কোনো চোখের হাসপাতাল তো আপনার দরকার নেই। তবু জানতে
চাইছি, হ্যালুসিনেশনের ব্যাপারটা
কি আপনার সহজাত, নাকি সযত্নে লালিত?
অমিতাভ
প্রশ্নগুলো খুব
কঠিন অনুপম। উত্তর দিতে দিতেই বরং চেষ্টা করি প্রশ্নগুলোর কাছে পৌঁছতে পারি
কিনা!
এডগার এলান পো
আমি জানিনা। আমার জানাশোনার দৌড় আরো অনেকের মতো তোমারও তো অজানা নয়। আমার বেঁচে থাকাটাই একটা হ্যালুসিনেশন। যার থেকে
আমি বেরিয়ে আসতে চেয়েছি। এখন পঁয়ষট্টি ছুঁয়েছি। এখন বুঝি আমার আর পরিত্রাণ নেই এর থেকে। সারাজীবন
এক অবসান আমাকে ঘিরে থেকেছে। অবসানের এক কাল্পনিক ভূখণ্ডে আমি চিরজীবনের
অসম্পৃক্ত। জাঁ বাপ্তস্ত ক্লামাঁস-এর মতো এক ছদ্ম অনুতাপের গল্পে অন্যের বিশ্বাস পাওয়ার বোকা বোকা চেষ্টা করে
যাচ্ছি। (অনুপম, মনে আছে? The Fall উপন্যাসের শেষ একটিমাত্র শব্দে “Fortunately” -- ভাগ্যিস। আমার সব কথা হয়ে যাবার পর এই
‘ভাগ্যিস’ শব্দটি আসুক। ঐ একটি শব্দ গোটা উপন্যাসটিকে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরিয়ে দিয়েছিল।) এই জাঁ বাপ্তিস্ত ক্লামাঁস এবার তার নির্মিত আত্মায়
অংশ দেবে।
তিন বছর
বয়সে এক সকালে বড়কাকুর কোলে উঠে আমি দেখেছিলাম বাড়ির পেছনে আমবাগানে অনেক উঁচুতে গলায়
দড়ি বাঁধা একজন মানুষ ঝুলছে। জোরে বাতাস বইছিল। খেলনা পুতুলের মতো বাতাসে ঘুরছিল লোকটা। শুনলাম ও
সুখেশ্বর -- কাঠের মিস্ত্রি। কাউকে বলিনি সারারাত্তির আমি ওর কান্না শুনেছিলাম। নিজের মধ্যেই প্রশ্ন উঠত
-- সত্যিই কি আমি শুনেছি ওর কান্না। যদি শুনে
নাও থাকি সেই কান্না নিশ্চয়ই ছিল কোথাও
-- নিজেই মনে মনে ঠিক বুঝে গেলাম। আমার একা
একা ছাদে চলে আসা শুরু হল মাঝে মাঝেই। ডাল পাতা কেটে সুখেশ্বরকে নামানোর জন্য
গাছের ঐ জায়গাটা শূন্য। সেই শূন্যের দিকে আমি মনে মনে বিড়বিড়
করতাম -- কাঁদছিলে কেন?
বছর
পাঁচ বয়স হয়েছে তখন। আমার শান্ত চিররুগ্ন মা এক বিকেলে বিছানায়
শুয়ে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। বাবা বাড়িতে নেই। আমার হঠাৎ পাগল হয়ে য়াওয়া ঠাকুমাকে আটকে রাখতে হয় ঘরে। মা দুর্বল গলায় বলে উঠল
-- “একটু জল দিবি, বাবা!” শুনেই কান্নায় গলা রুদ্ধ হয়ে গেল আমার। কোনোদিন “বাবা” বলে ডাকেনি তো মা
আমাকে! যারা ভিক্ষে চেয়ে ঘোরে - এমন করুণ
গলায় তারাই তো কিছু চায়। মা কেন চাইবে! মুখ ফিরিয়ে ঘাড় শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। না, আমি জল দেবো না। মা আরেকবার ডাকলো। আমি মুখ ফেরালাম। দেখলাম অদ্ভুত বেদনার্ত চোখে মা তাকিয়ে
আছে আমার দিকে। আমার মনে হল : অবসান। নিজেকে সামলে জল নিয়ে এলাম মার জন্য। গ্লাস হাতে দিয়ে ফিসফিস করে বললাম -- “কাঁদছিলে কেন?”
যে
কোনো কান্নার সামনে আমি সারাজীবন হেরে ভূত হয়ে যাই,
অনুপম। সত্যিই।
তখন
ক্লাস নাইন। বারুণি স্নানের দুপুরে মা আর কাকিমার সাথে আমার কাকার ছেলে আর
আমার বোন গঙ্গাস্নানে গেছে। দু’ঘন্টা পরে একটা জিপ এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে।
শুনলাম
আমার ভাই আর বোন গঙ্গায় ডুবে গেছে। তোলা হয়েছে। এখন হাসপাতালে। ওঁরা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন।
অনেক লোকজন চারপাশে। একজন বললেন, “ছেলেটা তো মারা গেছে জলের নীচেই। মেয়েটা বাঁচবে
হয়তো।’’ জিপের পিছনে আমি কেঁদে উঠলাম জোরে। সহৃদয় মুখের একজন এসে বললেন,
“কেঁদোনা। মারা যায়নি কেউ।”
আমার কান্না থেমে গেল এক মুহুর্তে। ভদ্রলোক আমাকে
সান্ত্বনা দিয়েছিলেন আসলে। ভাইটি মারাই গেছিল। নিউমোনিয়া থেকে কোনোক্রমে বেঁচে ফিরেছিল বোন।
কিন্তু
একটা অদ্ভুত প্রশ্ন জেগে উঠল আমার মধ্যে। কেউ মারা যায়নি শুনে কেন আমার কান্না
এক মুহুর্তে থেমে যায়? ভেতরে কি খুব তীব্র কষ্ট আদৌ ছিল?
নাকি আমার কান্না ছিল নিছক সামাজিক অনুষ্ঠান? প্রশ্নের উত্তর আজও নেই, অনুপম। ওর ফেলে যাওয়া লাট্টু আর প্রাণাধিক ইয়োইয়ো ছুঁয়ে ফিসফিস করে জিগ্যেস
করতাম কাঁদছিলি তুই? আমি তো কাঁদিনি, দ্যাখ।
নিজের
অবসানের কাছাকাছি এসে আজ তোমাকে বলি অনুপম
-- আমার কোনো মানবিক অনুভূতিই কখনও নেই। আমার কষ্ট
নেই, কান্না নেই, শোক নেই, আনন্দে প্রাণখুলে হেসে ওঠা নেই, লোভ নেই, আসক্তি নেই, কিছু নেই। কোনদিনই ছিলনা।
শুধু
বিস্ময় আছে। আর উন্মাদ কল্পনা। বিশ্বস্তভাবে, সারাজীবন, আমার সঙ্গে।
জীবন
নয়, জীবনের ফেলে রাখা ছায়াগুলো
আমায় টানত। দুপুরে ছাদে একা মোড়ায় বসে আমি ছায়াদের দেখতাম। আমার জন্মের সময় লাগানো আঙুর গাছ -- তার পাতার ছায়া, বাঁশের
মাথায় এসে বসে থাকা কাকের ছায়া, মোরায় বসে থাকা আমার ছায়া। হ্যারিকেনের আলোয় আমার ঠাকুমার ছায়া দেয়ালে পড়েছে। খবর কাগজ নিয়ে বসে থাকা দাদু। কাগজ পেন্সিলে
সব ছায়া এঁকে রাখতাম। অনেক ছায়া আঁকা একটা খাতা -লুকিয়ে রাখতাম একটু। মনে হতো ছায়ারাও জীবন্ত। আমার ছায়াও
হয়তো আমার মতো দাদুর ছায়ার হাত ধরে ঘুরে বেড়ায় কোথাও যেটা আমি দেখতে পাইনা। একদিন ঠিক ধরে ফেলব ওদের।
ছাদে
বসে থাকতে থাকতে একদিন দেখলাম একটা ছোট্ট সবুজ প্লেন ডানার মৃদুগুঞ্জন নিয়ে নেমে আসছে
নীচে, আবার উঠে যাচ্ছে। এঁকে বেঁকে উড়ছে। কিন্তু চলে যাচ্ছে না। তারপর একসময় উড়ে গেল প্লেনটা। আমার মনে
হলো আমি শুনতে না পেলেও প্লেনটা কিছু বলতেই এসেছিল আমাকে। বলা শেষ করে
চলে গেছে। অনেকদিন ভাবতাম সেই প্লেনটার কথা -- কী বলতে এসেছিল?
ভারী
বৃষ্টির পর আমি জলের নীচে আকাশ দেখতে বেরোতাম। তকন বিশ্বাস
করতাম পায়ের একটু নীচেই আকাশ থাকে। বৃষ্টির জলে মাটি ধুয়ে গেলে সেটা দেখা
যায়। একবার সেই জলে পা রাখলে অনেক নীচের আকাশে পড়া যায়। আর বাড়ি আসতে পারবো না কখনো। গরমকালে একবার
শুনলাম কুয়োর জল শুকিয়ে গেছে। আমি ছুটে গেছিলাম কুয়োর নীচের আকাশ দেখতে। কুয়োর দেয়ালে খাঁজ কাটা থাকে প্রয়োজনে ওঠা নামার জন্য। মনে হয়েছিল খাঁজে পা রেখে আস্তে আস্তে ঠিক আাকাশের কাছে নামতে
পারব এবার।
দালি
অহংকার বলেছিলেন “I am surrealism.” আমি হতাশায় ভেঙে
পড়ে বলছি আজ “I am hallucination.” আমার অস্তিত্বই এক এনিগমা,
এক হ্যালুসিনেসন। নিজের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে যখন নিজেকে দেখি, তখন অস্তিত্বের এই হ্যালুসিনেসনকেই আমার সত্যিকারের
আমি বলে বুঝতে পারি।
অনুপম
অমিতাভ
কোথাও থাকিনা। আমি শুধু আমার অনুভব আর দেখার মধ্যে থাকি - যেখানে এইসব তত্ত্ব, সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায় - “নীরার হাস্যের মতো অবান্তর লাগে।”
কুকুরটা আমি। তুমি। আমরা সবাই। আমাদের সবার
মুখেই জ্বলন্ত চকোলেট বম রাখা আছে,
যা সময়ে ঠিক ফেটে যায় নির্ভুলভাবে। মুখে বম্ গোঁজা
দুয়েকটা মানুষের কথা বলি, অনুপম? শুনবে?
●
১৯৯৩, কৃষ্ণনগর। আমার সরকারী
ফ্ল্যাটে রাত সাড়ে এগারোটায় পুলিশের গাড়ি এল। আর আধঘন্টার
মধ্যে গীর্জায় বড়োদিনের প্রার্থনা শুরু হবে। প্রবল ঠান্ডাতেও রাস্তায় অনেক মানুষ। উৎসবের আবহ। আমি যাচ্ছি হাসপাতালে। যাচ্ছি বত্রিশবছরের এক মহিলার মৃত্যুকালীন জবানবন্দী নিতে। বেডে একটু হাসিমুখে শুয়ে আছে মেয়েটি। অজস্র জবানবন্দী
নিয়ে গেছি সারাজীবন। আঙুল পুড়ে গেছে লিখতে লিখতে। চোখ জলসে গেছে। মেয়েটির শরীরে কোনো আঘাত বা আগুনের
দাগ নেই। ডাক্তার এগিয়ে এলেন। বললেন মেয়েটি সম্ভবত আর কথা বলতে পারবে
না। হাসিমুখে একইভাবে শূন্যে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। মেয়েটির চোয়ালে অভ্যস্ত চাপ দিলেন ডাক্তার। মুখ কুলে গেল এবং আমি দেকলাম বিশ্বরূপ। মুখে এক বোতল
অ্যাসিড জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেখলাম সেদ্ধ ছাড়ানো বড়ো একটা ডিমের
মতো ফটফটে সাদা জমাট হয়ে গেছে তালু,
জিভ, দাঁত, ঠোঁটের ভেতরের
অংশ। জবানবন্দী দেওয়া হয়নি ওর,
বাঁচেওনি। অনেক পরে “টোটেম ভোজ”-এর একটা কবিতায়
দৃশ্যটি এল - “কেননা কন্ঠনালী ভরে আছে সেদ্ধ সাদা ডিম ও কুসুম।” হাঃ!
আঙুল খসে যাওয়া, বেঁকে যাওয়া হাত পা, চোখ আর ঠোঁট পুড়ে যাওয়া মেয়েটির মুখে ছিল হাসির আভাস। মাড়ি বেরিয়ে গেছে হাসির চমকে। পুলিশের স্লিপে লেখা ছিল ৯০% বার্ন। মাথায় চুল নেই। পুরু করে সারা শরীরে বার্নল জাতীয় কিছু লেপে দেওয়া। তার ওপরে এক শিশি মারকিউরোক্রোম ঢেলে দেওয়া হয়েছে। বছর পঁয়ত্রিশের এক মহিলা হাতপাখা দিয়ে হাওয়া দিচ্ছেন। পোড়া শরীরে মহিলার বয়স নব্বই এর কাছাকাছি। এঁকে মেরে ফেলে কার কী লাভ? প্রশ্ন করলাম ডাক্তারকে। চোখে আগুন জ্বেলে এবার আমার সামনে এলেন পাখা হাতে মহিলাটি। বললেন মেয়েটি ওঁরই মেয়ে। বছর ১৩ বয়স। বাড়িতে কেউ ছিল না। কয়েকটি ছেলে এসে সেই সুযোগে কর্তব্য শেষ করে অজ্ঞান শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে গেছে। স্মারক হিসেবে।
ফেরার সময় দোতলা এক বাড়ির বারান্দায় এক নারীকে দেখলাম যত্নে ক্রিম লাগাচ্ছেন তার গায়ে। আশা করা যায় তার শরীর সেই ক্রিম উন্মুখ ভাবে গ্রহণ করছে। হাসপাতালের মেয়েটির শরীরেও ক্রিমের পুরু প্রলেপ। কিন্তু তার শরীর নিঃশব্দে প্রত্যাখান করেছে সেই ক্রিমকে।
[ মৃত্যু, যন্ত্রণা, জবানবন্দী, রক্তমাখা/পোড়া পোশাক, পোড়া মাংস আর রক্তের গন্ধে আমার "যে দিন ভেসে গেছে" অনুপম। কয়েকশো ইনকোয়েস্ট আর ডাইং ডিক্লেয়ার এর অভিজ্ঞতা খুব কম জনেরই আছে, এটা আমি জেনে বুঝেই বলছি। গলা পচা মৃতদেহগুলোর গন্ধ তাড়াতে প্রচুর ডেটল ঢেলে জামাকাপড় কাচা হত আমার। কড়া রুমফ্রেশনার গায়ে লাগাতাম। এক অসহনীয় মানসিক চাপে রাতের পর রাত ঘুম আসেনি। কবিতা লেখা তো আগেই ছেড়েছিলাম। এবার পড়াও বন্ধ করলাম। পরিবর্তে হাতে নিলাম ভার্জিল, ওভিদ, ফ্রয়েড, ইয়ুং, অ্যাডলার। ফ্রেজারের Golden Bough, জেসি ওয়েষ্টনের From Ritual to Romance, এরিক ফ্রোমের Anatomy of Human Destructiveness" আর দান্তে। মহান দান্তে। বিশেষ করে Inferno আর Pargaturio।
ঠিক করলাম, আবার লিখব। আর সেই লেখায় আমার দেখা এইসব মানুষজনই আসবে। আর কিছু না। কবিতার ন্যূনতম চিহ্ন বর্জন করতে হবে। লাবণ্য যোজনা আর করব না শব্দে। পোড়া মেয়েটির মত ছাই যেন হয়ে ওঠে আমার লেখা। পুড়ে আঙুল খসে পড়ার বাস্তবতা যেন আনতে পারি লেখায়। গলায় মৃত অ্যালবাট্রস পাখি ঝোলানো নাবিকের মত দাঁড়িয়ে থাকব অন্ধকারে, আমার দেখা জীবনের গল্প শোনাতে। টোটেম ভোজ এর পরিকল্পনা করতে শুরু করলাম যেখানে ম্যাডাম এম নামের একজন এলেন আগুনে, বিষে, হত্যায়, ধর্ষণে শেষ হয়ে যাওয়া মেয়েদের কণ্ঠস্বর হয়ে। আগুনে বেঁকে যাওয়া হাড়ের মত আড়ষ্ট করে দিলাম ভাষাকে। বাইবেলের বাংলা অনুবাদের ভাষাকে সামনে রেখে, গ্রহণ করে এক কৃত্রিম ভাষায় লেখা হল টোটেম এর কবিতাগুলো। একটি শব্দও এখানে প্রেরণাপ্রাপ্ত হয়ে আসেনি এবং প্রেরণায় আমি এক বিন্দু বিশ্বাস করি না। একটা pseudo epic এর আদল এল ভাবনায়। Invocation to the Muse এর আদলে প্রথম কবিতাটি রাখলাম- বরপ্রদানের বদলে এল অভিশাপ। ওল্ড টেস্টামেন্টের আদলে লেখা হল "সৃজনমূলক সাতটি দিন"। ]
●
মর্গে এসেছি কাস্টোডিয়াল ডেথের পোস্টমর্টেম
করতে। এই সব মৃত্যুর পোস্টমর্টেম করতে হয় ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে। একটা বছর দেড়েকের ছেলের মৃতদেহ মর্গের মেঝেয় পড়ে। জানলাম বেথুয়াডহরীর এই ছেলেটিকে উঁচু মাচায় বসিয়ে মা গেছে পুকুর
ঘাটে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় নীচে পড়ে যায় যেখানে অনেক লোহার রড পোঁতা। একটা রড শিশুটির চোখ দিয়ে ঢুকে খুলির পিছনের অংশ দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। custodial death এর ইনকোয়েস্ট শুরু হল। মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। ছুরির জোরালো
টানে ঠোঁট দু'ফাঁক করে হুরমুর
করে বেরিয়ে আসা পচা নাড়িভুঁড়ি থেকে প্রয়োজনীয় নমুনা তুলে রেখে ডোম এবার খুলির চামরা
তুলে ফেলল ছুরি দিয়ে তারপর চালের বস্তা নামানোর সময় ব্যবহৃত হাতলযুক্ত কাঁটার মত একটা
জিনিস হাঁতুড়ি দিয়ে কপালে আমূল গেঁথে উঠে দাঁড়ায় ডোম। জোরে দম নেয়। তারপর এমন জোরে ঝটকা দেয় যে নিজেই ঝটকে পড়ে যায় সে। যেন উড়ে তিনহাত দূরে গিয়ে পড়ে সেই মৃতদেহ। খুলি ছিটকে পড়েছে বাইরে আর কালো রক্ত আর ঘিলুর ঘনস্রোত গড়িয়ে পরছে
মেঝেয়।
●
জলপাইগুড়ি
মর্গ। মহকুমা শাসকের ডাক পড়ল একদিন।
N.J.P স্টেশনের বাইরে ট্রেনলাইনে দু'টো মেয়েকে
গণধর্ষণের পর সাধারণ সৌজন্যে হাত-পা বেঁধে ট্রেন লাইনে শুইয়ে
রেখে চলে গেছে। তার ইনকোয়েস্ট। ডাঃ দাশগুপ্ত ( কবি সৌমনা দাশগুপ্তের স্বামী) ও আছেন আমার সাথে। সব্জী বিক্রেতাদের কুমড়ো ঠাসা বস্তার মত ২ টা বস্তা রাখা আছে রিক্সো- ভ্যানে। একজন ডোম
এসে বস্তাদুটো খুলে দিতেই শশব্যস্তে নেমে এল চারটে কাটা হাত, চারটে কাটা পা আর দুটো দিবাস্বপ্নহীন কাটামুন্ড
( সুনীলের "আমি কিরকম ভাবে..."
তে এরকম নামের একটা কবিতা আছে না অনুপম!) আধখোলা
চোখের একটা মুখ তার ধর্ষণে ছেঁড়া খোঁড়া শরীর নিয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। এখন আমি
অনেক বড়ো হয়ে গেছি যে! এখন তো আর রুদ্ধস্বরে জানতে চাইব না
- "কাঁদছিলে কেন? "
একটি মেয়ে, জ্বলন্ত গ্যাস অভেনে মাথা ঢোকানো, মৃত। অভেনের পাশে ঠিক সিলিন্ডারের মতো লাল
একটা আপেল। দেখেছিলাম দৃশ্যটা একদিন।
( টোটেমের শেষ কবিতায় ম্যাডাম এম. এর মৃত্যুদৃশ্য
এরকম ছিল হয়তো।)
অজস্র এমন মুখ, অনেক চিৎকার আমার ভেতরে ডুবে আছে। যাঁরা পড়ছেন তাঁরা রক্তপাতের এই মরুভূমিতে আর দাঁড়াতে চাইবেন না
হয়তো। তবু…. “These are the fragments I have shored
against my ruins.” হাঃ!
আমি জানিনা খৃষ্টীয় বা বৈষ্ণবদের করুণা কী দিয়ে ব্যাখ্যা করা উচিত একে। করুণা আমার হয়নি। এক মধুর স্বপ্নময় দূরত্বের চোখে দেখা
থেকেই করুণা আসে। আমার কোনো দূরত্ব ছিল না,
জড়িয়ে থেকেছি। স্বেচ্ছায়।
অনুপম
এই যে অপরের যন্ত্রণার মধ্যে অংশগ্রহণ, সেখানে বিভূতিভূষণসুলভ কোনো 'তালনবমী' নেই। কোনো 'অভাগীর স্বর্গ' নেই। অনিযার্য হিংসা, অপ্রতিরোধ্য যৌনতা, নাছোড়
লোভ আর বাধ্যতামূলক নৈতিকতার মধ্যে লেনদেন কি আছে কিছু? 'টোটেম
ভোজ'-এর কবিতাগুলো কতটা নৈতিক, অন্তত বাঙালিভাবে?
মধ্যবিত্ত নৈতিকতার কথা বলছি না, তাহলে তো আমাদের
এখানে কলম ধরাই চলে না। আবহমানভাবেই বলছি।
অমিতাভ
বিষ ঢেলে মুখ বেঁধে দেওয়া মেয়েটির
মুখে যেমন গলে মিশে এক হয়ে যায় ঠোঁট,দাঁত,জিভ,মুখগহ্বর-নিশ্চিত থাকো অনুপম
-হিংসা,যৌনতা লোভ-ঠিক সেভাবেই
জড়িয়ে থাকে।প্রশ্নগুলো আমাকে আবার একটা
ঘটনা মনে পড়ালো।বলি?
তরুণ একজোড়া দম্পতি দুপুরের জলপাইগুড়ি শহরের রাস্তায়।থমথমে মুখ দুজনেরই।মেয়েটির হাত ধরে ছেলেটি কিছু একটা বোঝাতে চাইছে নিচু গলায়।ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছে মেয়েটি।গাল ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে কিন্তু রাগে গনগন করছে মুখ।এরপর ছেলেটি অনুনয়ের রাস্তা থেকে সরে যায়।টানতে টানতে নিয়ে যায় মেয়েটিকে।জোর করে রিক্সোয় তুলে দেয়।
তিনদিন পর জলপাইগুড়ি হাসপাতাল থেকে এক রাতে আমাকে জানানো হলো কীটনাশক খেয়ে একজন মহিলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন,বাঁচবেন না সম্ভবত,তাঁর মৃত্যুকালীন জবানবন্দী নিতে হবে।গেলাম।মহিলাটি তখন আর কথা বলার অবস্থায় নেই।শুধু জানতে পারলাম উনি নিজেই বিষ খেয়েছেন।অনেকভাবে চেষ্টা করেও আর কোনো কথা জানা গেল না।পরদিন মেয়েটির মৃত্যু সংবাদ এলো।
আমার সিকিউরিটি জানালো এই মেয়েটি এবং তার স্বামীকেই সেদিন রাস্তায় ঝগড়া করতে দেখা গেছে।মেয়েটির স্বামী এবং শ্বশুরকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।দিন তিনেক পরে খবর এলো জেলখানায় একজন বন্দীর custodial death হয়েছে।তার ইনকোয়েস্ট এবং পোস্টমর্টেম করতে হবে।হাজতের মধ্যে মৃত্যু হলে এই গোটা প্রক্রিয়াটির ভিডিওগ্রাফি করে মানবাধিকার কমিশনে পাঠাতে হয়।জানলাম সেই মেয়েটির স্বামী হাজতের টয়লেটের জানলায় গামছা বেঁধে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।খুব উঁচু নয় জানলাটা।মেঝের ওপর খুব আরামদায়ক ভাবে বিশ্রাম করছে লোকটির পা। এভাবে মৃত্যু সম্ভব নয় যদি না লোকটি গামছা বাঁধা গলায় শূণ্যে লাফিয়ে উঠে এক ঝটকায় নিজের ঘাড় ভেঙে ফেলে।সেটাই সে করেছিল বাস্তবিক।মৃতদেহটির পাশে বুক চাপড়ে কাঁদছে লোকটির বাবা-যে নিজেও সেই সেলেই কয়েদি।তার থেকেই জানলাম তার স্ত্রী মারা গেছে অনেকদিন আগে।একমাত্র ছেলে বিয়ের কয়েকমাস পর থেকেই মানসিক অবসাদে ভুগছে।জানালো তার বৌমা,ভীষণ রাগী।রোজ রাতে চিৎকার করতো,বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইতো।দেখছিলাম মানুষটিকে।বিশাল চেহারা।কালো রং গায়ের।একমাথা সাদা চুল।মন্ত্রোচ্চারণের মতো সারাক্ষণ সে বলে চলেছে,তাকে শাস্তি দেওয়া হোক।স্ত্রী নেই সন্তান নেই-কোনো ভয় আর এখন নেই তার,পিছুটান নেই।করজোড়ে নিজের মৃত্যু চেয়ে এখন সে কেঁদে চলেছে।
এই মৃত দম্পতি আর এই জীবিত বৃদ্ধটির মধ্যেই প্রবাহিত হয়ে চলেছিল তিন রকমের বোধ-পরে জানলাম।
যে মেয়েটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্বামীর হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছিল,তীব্র ক্রোধ নিয়ে ধাক্কা দিয়েছিল স্বামীকে,বিষ খেয়ে আত্মহত্যার সময় সেই মেয়েটির শরীরে সন্তান ছিল।সন্তানটি সে বাঁচাতে চায়নি।নিজেও বাঁচতে চায়নি।কেননা নিজের গর্ভে সে ধারণ করেছিল তার স্বামীরই ভাই।সৌজন্য-সেই মেয়েটির শ্বশুর।মেয়েটির পক্ষে কোনোভাবেই আর সম্ভব ছিলনা এই বর্ণনাতীত জীবনকে মেনে নেওয়া।তার স্বামী সব জেনেও মেনে নিয়েছে এই অদ্ভুত জীবন,কেননা সে উপার্জনহীন।বাবার টাকা দিয়েই তাকে নিজের জন্য ঘুমের ওষুধ আর বাবার জন্য কন্ডোম কিনতে হয়।স্ত্রীর জন্য তার পাগলের মতো ভালবাসা ও কান্না সে বুঝিয়ে দিয়েছে জেলে তিনদিন অভুক্ত থেকে,পাগলের মতো দেয়ালে মাথা ঠুকে এবং এক মরিয়া চেষ্টায় প্রাণবিসর্জন দিয়ে।জীবনের হাত থেকে তাকে নিতে হয়েছে এই এক রক্তমাখা পুঁথি যা পড়ার জোর তার ছিল না।এই জোর আমাদেরও নেই। তোমার প্রশ্নের উত্তর হয়তো এর মধ্যে নেই। আবার আছেও হয়তো কোথাও। জানিনা।
কোনো শিল্পের সাথেই নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে তো হিতোপদেশ, ঈশপের গল্পই মহত্তম সৃষ্টির তকমা পেত। আমি একটু চিন্তায় পড়লাম "বাঙালী নৈতিকতা"র প্রসঙ্গে। সামাজিকতার শর্ত তো মানতেই হয়, সমাজে বাস করি যেহেতু। কিন্তু আর কিছু নেই যা তেমন গুরুত্বের।
এবার "টোটেম" ইত্যাদির প্রসঙ্গে আসি। বইটির ১০০ মাইলের মধ্যে যেন কবিতা না থাকে এটা ছিল আমার প্রথম ভাবনা। কেননা যে angst এর ভেতর দিয়ে তখন আমার দিন যেত, তা কবিতা সহায়ক নয়। আগের প্রশ্নে এ নিয়ে বলেছি।
টোটেম একটি বিষ বমি। কোনো সাহিত্য নয়। কেউ পড়বে এটা আমি ভাবিইনি। ভাষা যেন ভদ্রতা করছে, ফর্মাল দূরত্ব রেখে। প্রায় প্রতিটি কবিতার ওপরেই এল বিদেশি লেখা থেকে উদ্ধৃতি। যা নীচের text-এর একদম বিপরীত কিছু বলছে। এভাবে একরৈখিকতাকে ভাঙার চেষ্টা। আমার উদ্দেশ্য ছিল জোরে ধাক্কা দেওয়া, ভাঙা। আমার তো হারানোর কিছু নেই, তাই দেবদূতরা যেখানে পা রাখতে ভয় পান, সেখানে হাসতে হাসতেই লাফিয়ে পড়া উচিত আমার।
[মূর্খরাই পথপ্রদর্শক। তারাই কোনো মহৎ কাজের প্রথম স্বার্থহীন জ্ঞানী শহিদ। ]
কবিতায় ভাঙচুর -- এসব আমি ভাবিইনি। নিজের ভাঙাচোরা অস্তিত্বকে বোঝার চেষ্টা একরকমভাবে, আমার নিজের ধরণে।
তরুণ একজোড়া দম্পতি দুপুরের জলপাইগুড়ি শহরের রাস্তায়।থমথমে মুখ দুজনেরই।মেয়েটির হাত ধরে ছেলেটি কিছু একটা বোঝাতে চাইছে নিচু গলায়।ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছে মেয়েটি।গাল ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে কিন্তু রাগে গনগন করছে মুখ।এরপর ছেলেটি অনুনয়ের রাস্তা থেকে সরে যায়।টানতে টানতে নিয়ে যায় মেয়েটিকে।জোর করে রিক্সোয় তুলে দেয়।
তিনদিন পর জলপাইগুড়ি হাসপাতাল থেকে এক রাতে আমাকে জানানো হলো কীটনাশক খেয়ে একজন মহিলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন,বাঁচবেন না সম্ভবত,তাঁর মৃত্যুকালীন জবানবন্দী নিতে হবে।গেলাম।মহিলাটি তখন আর কথা বলার অবস্থায় নেই।শুধু জানতে পারলাম উনি নিজেই বিষ খেয়েছেন।অনেকভাবে চেষ্টা করেও আর কোনো কথা জানা গেল না।পরদিন মেয়েটির মৃত্যু সংবাদ এলো।
আমার সিকিউরিটি জানালো এই মেয়েটি এবং তার স্বামীকেই সেদিন রাস্তায় ঝগড়া করতে দেখা গেছে।মেয়েটির স্বামী এবং শ্বশুরকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।দিন তিনেক পরে খবর এলো জেলখানায় একজন বন্দীর custodial death হয়েছে।তার ইনকোয়েস্ট এবং পোস্টমর্টেম করতে হবে।হাজতের মধ্যে মৃত্যু হলে এই গোটা প্রক্রিয়াটির ভিডিওগ্রাফি করে মানবাধিকার কমিশনে পাঠাতে হয়।জানলাম সেই মেয়েটির স্বামী হাজতের টয়লেটের জানলায় গামছা বেঁধে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।খুব উঁচু নয় জানলাটা।মেঝের ওপর খুব আরামদায়ক ভাবে বিশ্রাম করছে লোকটির পা। এভাবে মৃত্যু সম্ভব নয় যদি না লোকটি গামছা বাঁধা গলায় শূণ্যে লাফিয়ে উঠে এক ঝটকায় নিজের ঘাড় ভেঙে ফেলে।সেটাই সে করেছিল বাস্তবিক।মৃতদেহটির পাশে বুক চাপড়ে কাঁদছে লোকটির বাবা-যে নিজেও সেই সেলেই কয়েদি।তার থেকেই জানলাম তার স্ত্রী মারা গেছে অনেকদিন আগে।একমাত্র ছেলে বিয়ের কয়েকমাস পর থেকেই মানসিক অবসাদে ভুগছে।জানালো তার বৌমা,ভীষণ রাগী।রোজ রাতে চিৎকার করতো,বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইতো।দেখছিলাম মানুষটিকে।বিশাল চেহারা।কালো রং গায়ের।একমাথা সাদা চুল।মন্ত্রোচ্চারণের মতো সারাক্ষণ সে বলে চলেছে,তাকে শাস্তি দেওয়া হোক।স্ত্রী নেই সন্তান নেই-কোনো ভয় আর এখন নেই তার,পিছুটান নেই।করজোড়ে নিজের মৃত্যু চেয়ে এখন সে কেঁদে চলেছে।
এই মৃত দম্পতি আর এই জীবিত বৃদ্ধটির মধ্যেই প্রবাহিত হয়ে চলেছিল তিন রকমের বোধ-পরে জানলাম।
যে মেয়েটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্বামীর হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছিল,তীব্র ক্রোধ নিয়ে ধাক্কা দিয়েছিল স্বামীকে,বিষ খেয়ে আত্মহত্যার সময় সেই মেয়েটির শরীরে সন্তান ছিল।সন্তানটি সে বাঁচাতে চায়নি।নিজেও বাঁচতে চায়নি।কেননা নিজের গর্ভে সে ধারণ করেছিল তার স্বামীরই ভাই।সৌজন্য-সেই মেয়েটির শ্বশুর।মেয়েটির পক্ষে কোনোভাবেই আর সম্ভব ছিলনা এই বর্ণনাতীত জীবনকে মেনে নেওয়া।তার স্বামী সব জেনেও মেনে নিয়েছে এই অদ্ভুত জীবন,কেননা সে উপার্জনহীন।বাবার টাকা দিয়েই তাকে নিজের জন্য ঘুমের ওষুধ আর বাবার জন্য কন্ডোম কিনতে হয়।স্ত্রীর জন্য তার পাগলের মতো ভালবাসা ও কান্না সে বুঝিয়ে দিয়েছে জেলে তিনদিন অভুক্ত থেকে,পাগলের মতো দেয়ালে মাথা ঠুকে এবং এক মরিয়া চেষ্টায় প্রাণবিসর্জন দিয়ে।জীবনের হাত থেকে তাকে নিতে হয়েছে এই এক রক্তমাখা পুঁথি যা পড়ার জোর তার ছিল না।এই জোর আমাদেরও নেই। তোমার প্রশ্নের উত্তর হয়তো এর মধ্যে নেই। আবার আছেও হয়তো কোথাও। জানিনা।
কোনো শিল্পের সাথেই নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে তো হিতোপদেশ, ঈশপের গল্পই মহত্তম সৃষ্টির তকমা পেত। আমি একটু চিন্তায় পড়লাম "বাঙালী নৈতিকতা"র প্রসঙ্গে। সামাজিকতার শর্ত তো মানতেই হয়, সমাজে বাস করি যেহেতু। কিন্তু আর কিছু নেই যা তেমন গুরুত্বের।
এবার "টোটেম" ইত্যাদির প্রসঙ্গে আসি। বইটির ১০০ মাইলের মধ্যে যেন কবিতা না থাকে এটা ছিল আমার প্রথম ভাবনা। কেননা যে angst এর ভেতর দিয়ে তখন আমার দিন যেত, তা কবিতা সহায়ক নয়। আগের প্রশ্নে এ নিয়ে বলেছি।
টোটেম একটি বিষ বমি। কোনো সাহিত্য নয়। কেউ পড়বে এটা আমি ভাবিইনি। ভাষা যেন ভদ্রতা করছে, ফর্মাল দূরত্ব রেখে। প্রায় প্রতিটি কবিতার ওপরেই এল বিদেশি লেখা থেকে উদ্ধৃতি। যা নীচের text-এর একদম বিপরীত কিছু বলছে। এভাবে একরৈখিকতাকে ভাঙার চেষ্টা। আমার উদ্দেশ্য ছিল জোরে ধাক্কা দেওয়া, ভাঙা। আমার তো হারানোর কিছু নেই, তাই দেবদূতরা যেখানে পা রাখতে ভয় পান, সেখানে হাসতে হাসতেই লাফিয়ে পড়া উচিত আমার।
[মূর্খরাই পথপ্রদর্শক। তারাই কোনো মহৎ কাজের প্রথম স্বার্থহীন জ্ঞানী শহিদ। ]
কবিতায় ভাঙচুর -- এসব আমি ভাবিইনি। নিজের ভাঙাচোরা অস্তিত্বকে বোঝার চেষ্টা একরকমভাবে, আমার নিজের ধরণে।
অনুপম
৬টা রিপু নিয়ে আপনার কবিতায় অদ্ভুত
জাগলিং চলে। তারা আপনার হস্তগত,
আবার নয়। ক্ষণমুহূর্তে আপনি জয়ী, আবার পরেই তাদের নিয়ন্ত্রণের খেলা। কাহ্লিল জিব্রানের সেই প্রফেট তো আমার মনে হয় জাহাজটার অপেক্ষায় আছে বলেই এত কথা
বলছে, এত কথা হয়ত সে জীবনে ঠোক্কর খেয়েই শিখেছে, কিছু করার নেই বলেই কথা বলছে লোকজনের সঙ্গে, জাহাজ পেয়ে
গেলেই উঠে পড়বে... অমিতাভ মৈত্র তাঁর কুশলী স্বীকারোক্তিগুলো
কি শুধুমাত্র সময় কাটানোর জন্যই সময়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রাখছেন? নাকি শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে যাওয়া কোনোকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাই হল
কবিতা?
অমিতাভ
রিপু শব্দটা যেন বহুদিন পর শুনলাম। আমি এতো ভাবিটাবিনি
অনুপম। কিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাও করিনি। কবিতাই যখন
লিখছিনা, তখন নিয়ন্ত্রিত উপস্থাপনার
দরকারই বা কী! কোনো খোলা স্যুইচে হাত দিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে
আমি কি আমার ভয়, যন্ত্রণা, চিৎকার কে নিয়ন্ত্রণ
করে প্রকাশ করবো! ‘কুশলী স্বীকারোক্তি’গুলো
লুকোতে চাইলে এতো অজস্র বকবক কি করতাম? জীবন আমাকে যা দেখিয়েছে,
আমি তার বাইরে কতটুকুই বা জানি? আমরা তো সারাজীবন
তো অর্জন করতে করতে আর হারাতে হারাতেই যাই। (ক্রমশঃ)
অভিভূত। কবিতা না, তোর লেখা আমাকে আছড়ে ফেলে এমন এক ভূমিতে, যেখানে যাওয়ার স্পর্ধা কোনদিনই আমার ছিল না। অনুপম সে সব দেখালো, ভয়ংকর এক ভয়ের মধ্যেই ফেলে দিল। বহুদিন এই ভয় আমাকে তাড়না করবে, নিশ্চয়ই।
ReplyDeleteপড়েছি। তবে পড়ার মতো হয়নি। আরও লাগবে। মনে হলো একটা সাইকোলজিক্যাল জার্নির ভেতর দিয়ে গেলাম।
ReplyDeleteএকটা ঝাঁকুনি হঠাৎ ব্রেক মারা পুরানো বাস। কিছু বলার নেই। ভয়ানক চোখ বুঝলেই ভয়ানক।
ReplyDeleteবাপ রে! কবির স্বীকারোক্তিকে যথাযথ সম্মান ও আন্তরিকতা দিতে চাইছি দিচ্ছিও তবু নিজের মাথাটা ড্যাংলিং করছে। থামাতে পারছিনা। নার্ভের জোর নেই।
ReplyDeleteবাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।
ReplyDeleteকোনো কথা বলার নেই।কুর্নিশ জানাই
ReplyDeleteএকটা কবি যে প্রতিনিয়ত একটা জলজ্যান্ত মৃত্যুর সঙ্গে সহাবস্থান করেন এটা বোঝা গেল। বাকরুদ্ধ।
ReplyDeleteচলুক ।
ReplyDeleteSpeechless.
ReplyDelete